ইউএসবি কানেক্টর; বর্তমানকালের প্রত্যেকটি স্মার্ট কিংবা আনস্মার্ট ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইউএসবি কানেক্টর বা পোর্ট এর নাম শুনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া সত্যিই মুশকিল। সবাই জানি যে, ইউএসবি দিয়ে ডেটা ট্রান্সফার থেকে শুরু করে কোন একটি যন্ত্র চলার মতো পাওয়ার ও দেয়া যায়। বহুল প্রচলিত এই প্রযুক্তিটি নিয়ে প্রায় সবারই প্রাথমিক ধারনা থাকলেও বিস্তারিত খুব কম মানুষই জানি। আবার, আমরা যারা নিজে থেকে এটা নিয়ে একটু জানার চেষ্টা করি তাদের মাথায়ও ইউএসবি নামক এই প্রযুক্তিটি নিয়ে অনেক প্রশ্ন আর কনফিউশন। কেমন হয় যদি একটি আর্টিকেল পড়েই “ইউএসবি” নামক রহস্যের কূলকিনারা করে ফেলেন! চেষ্টা করে দেখা ই যাক না হয়।
ইউএসবি কিঃ
ইউএসবি এর পূর্ণরূপ হচ্ছে ইউনিভার্সাল সিরিয়াল বাস। এটি একটি ডিভাইসের সাথে অন্য একটি ডিভাইস বা এক্সেসরিজ সংযুক্ত করার একটি বহুল ব্যবহৃত প্রযুক্তি। হ্যাঁ, ইউএসবি ছাড়াও এক ডিভাইসের সাথে আরেক ডিভাইস কানেক্ট করার আরো অনেক প্রযুক্তি আছে। তবে বহুল ব্যবহৃত ও দ্রুতগতির হওয়াতে বর্তমানকালে ইউএসবি কেই স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয়। তাছাড়া আজকাল বিভিন্ন ডিভাইসে পাওয়ার সাপ্লাই এর জন্যও ইউনিভার্সাল কানেক্টর হিসেবে ইউএসবি ই ব্যবহার করা হচ্ছে।
ইতিহাসঃ
ইউএসবি কানেক্টর এর ব্যবহার শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। তখনকার ইউএসবি আর আজকের ইউএসবির মাঝে কিন্তু বিশাল ফারাক। দিন যত গিয়েছে ইউএসবি তত দ্রুতগতি সম্পন্ন হয়েছে। একই সাথে আকার-আকৃতিতেও এসেছে বিশাল পরিবর্তন। ইউএসবি নিয়ে গবেষণা করে আরো উন্নয়ন ও এই প্রযুক্তিটির নিয়ন্ত্রণের জন্য ইউএসবি ইমপ্লিমেন্টারস ফোরাম নামক একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হয়েছে। এপল, মাইক্রোসফট কিংবা ইন্টেলের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এই সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে।
ইউএসবি কানেক্টরগুলো দিন দিন উন্নত থেকে উন্নততর হচ্ছে। ইউএসবি কানেক্টরের স্পিড ও ফিচার অনুযায়ী বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভার্সন এসেছে। ইউএসবি এর সর্বশেষ প্রচলিত ভার্সন হচ্ছে ইউএসবি ৩.২। চলুন এযাবৎ প্রচলিত ইউএসবির বিভিন্ন মেজর ভার্সন ও এর ফিচারগুলো দেখে নেয়া যাক।
- ইউএসবি ১.০ঃ এটা ইউএসবি প্রযুক্তির প্রাথমিক পাবলিক রিলিজ। ১৯৯৬ সালে সাধারণ মানুষের নাগালে আসে এই প্রযুক্তি। এর দুই ধরনের ভ্যারিয়েন্ট ছিল। একটি হলো লো স্পিড ভ্যারিয়েন্ট যার গতি ছিল ১.৫ এমবিপিএস (মেগাবিট/সেকেন্ড)। অপরদিকে অন্যটি ছিল ফুল স্পিড ভ্যারিয়েন্ট যার গতি ছিল প্রায় ১২ এমবিপিএস।
- ইউএসবি ২.০ঃ ইউএসবির এই মেজর ভার্সনটির ব্যবহার শুরু হয় ২০০০ সালে। একে ইউএসবি হাই স্পিড বলেও ডাকা হয়। এর ডেটা ট্রান্সফার স্পিড ছিল ৪৮০ এমবিপিএস। এত আগের ভার্সন হলেও ইউএসবি ২.০ আজকের দিনেও ল্যাপটপ, ডেস্কটপ কিংবা মোবাইল ফোনের মাইক্রো ইউএসবি পোর্টে খুঁজে পাবেন। তবে ডেটা ট্রান্সফারের চেয়ে এখনকার সময়ে শুধু পিসিতে বিভিন্ন এক্সেসরিজ কানেক্ট করতে এই ভার্সনটি ব্যবহৃত হয়।
- ইউএসবি ৩.০ঃ ২০০৮ এর শেষের দিকে রিলিজ পাওয়া এই ভার্সনটি ইউএসবি সুপার স্পিড নামে পরিচিত। খাতায়-কলমে এর সর্বোচ্চ গতি হলো ৫ জিবিপিএস (গিগাবিট/সেকেন্ড)। এর পরে আরো অনেক ভার্সন আসলেও এটাই বর্তমানে সর্বাধিক প্রচলিত। একে আবার ইউএসবি ৩.১ জেনারেশন ১ নামেও মাঝে মাঝে ডাকা হয়। অর্থাৎ ইউএসবি ৩.০ আর ইউএসবি ৩.১ জেনারেশন ১ প্রকৃতপক্ষে একই জিনিস। তাই ইউএসবি ৩.১ মানেই যে ৩.০ এর চেয়ে ভালো এমনটা নয়। আগে দেখতে হবে কোন জেনারেশনের কথা বলা হয়েছে। কোথাও ইউএসবি ৩.১ জেনারেশন ১ লেখা থাকলে বুঝবেন সেটা আর কিছু নয়, বরং ইউএসবি ৩.০ ই।
- ইউএসবি ৩.১ঃ এটাই প্রকৃত ইউএসবি ৩.১। ২০১৩ এর জুলাই এ রিলিজ হলেও এখনো প্রিমিয়াম ডিভাইস ছাড়া এই প্রযুক্তি সাধারণ গ্যাজেটে দেখা যায় না। এটাকে ইউএসবি সুপারস্পিড প্লাস বলা হয়। যেহেতু ইউএসবি ৩.০ কে ইউএসবি ৩.১ জেনারেশন ১ বলা হয় তাই এটাকে ইউএসবি ৩.১ জেনারেশন ২ নাম দেয়া হয়েছে। এর সর্বোচ্চ গতি হলো ১০ জিবিপিএস।
- ইউএসবি ৩.২ঃ আজ থেকে দুই বছর আগে মানে ২০১৭ সালে এর ঘোষণা আসলেও এই ভার্সনটি সাধারণ মানুষের নাগালে এখনো ভালোভাবে আসে নি। তাই অনেকেই হয়তো এখনো এই ভার্সনের নাম শুনেন নি। এটাকেও ইউএসবি সুপারস্পিড প্লাস বলে ডাকা হয়। তবে এর স্পিড আগের ভার্সনের দ্বিগুণ, মানে ২০ জিবিপিএস।
- ইউএসবি ৪.০ঃ এই মার্চেই আসছে ইউএসবি এর পরবর্তী মেজর রিলিজ ইউএসবি ৪.০। ইউএসবি সুপারস্পিড প্লাস নামে এটাকেও ডাকা হয়। তবে এর তাত্ত্বিক স্পিড আগের সবকিছুকে ছাড়িয়ে গিয়ে ৪০ জিবিপিএস হবে বলে জানানো হয়েছে।
আপনারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে নাম ইউএসবি হলেও পিসি, মোবাইল ফোন কিংবা অন্যান্য ডিভাইসের সাইজ অনুযায়ী ইউএসবি কানেক্টরের সাইজেও পার্থক্য দেখা যায়। আসলে বিভিন্ন ভার্সনের মতো ১৯৯৬ সাল থেকে ইউএসবি কানেক্টরের বিভিন্ন সাইজও এসেছে। সাইজ অনুযায়ী ইউএসবি কানেক্টরকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়।
- স্ট্যান্ডার্ডঃ স্ট্যান্ডার্ড সাইজের ইউএসবি টাইপ এ এবং টাইপ বি নামের দুটি আকৃতির হয়। এই স্ট্যান্ডার্ড সাইজের টাইপ এ সুপারস্পিড ও টাইপ বি সুপারস্পিড নামের আরো দুটি ভ্যারিয়েন্ট আছে। সুপারস্পিড কানেক্টর ও পোর্ট গুলো নীল রঙ এর হয় যার ফলে সহজেই চেনা যায়। এদের মাঝে টাইপ এ ও টাইপ বি কানেক্টরগুলো ইউএসবি ১.০ ও ২.০ সমর্থন করে। অন্যদিকে টাইপ এ সুপারস্পিড ও টাইপ বি সুপারস্পিড ইউএসবি ৩.০ ও ৩.১ এর স্পিড সাপোর্ট করে। টাইপ এ পিসি ও পাওয়ার এডাপ্টার এ খুব বেশি ব্যবহৃত হলেও টাইপ বি অনেক কম ব্যবহৃত হয়।
- মিনিঃ মিনি ইউএসবি কানেক্টরগুলোর তিনটি টাইপ বের হয়েছিল। এগুলো হলো টাইপ এ, টাইপ বি এবং টাইপ এবি। এগুলো ইউএসবি ২.০ এর স্পিড সাপোর্ট করতো। তবে পরে আর মিনি ইউএসবি ডেভেলপ করা হয় নি। বলতে গেলে এখন এটা বন্ধই হয়ে গেছে। কিছু ফিচারফোনে কিংবা এমপিথ্রি প্লেয়ারে হয়তো এখনও মিনি টাইপ বি ইউএসবি চোখে পড়বে।
- মাইক্রোঃ এই সাইজের ইউএসবি ই মনে হয় দুনিয়াতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। চিন্তা করে দেখুন একবার, ৮০০ টাকার ফিচারফোন থেকে শুরু করে দামি দামি স্মার্টফোনে এখনও মাইক্রো টাইপ বি ইউএসবি পোর্ট ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলো ইউএসবি ২.০ স্ট্যান্ডার্ড এর ডেটা ট্রান্সফার স্পিড সমর্থন করে। মাইক্রো টাইপ এ এবং মাইক্রো টাইপ এবি নামক আরো দুটি কম প্রচলিত ভ্যারিয়েন্ট ও আছে এদের। মাইক্রো বি খুব বেশি জনপ্রিয়তা পাওয়ায় একে আরেকটু উন্নত করে মাইক্রো বি সুপারস্পিড নামে আরেকটি ভ্যারিয়েন্ট বানানো হয়েছে। এটার সাইজ মাইক্রো বি এর চেয়ে একটু বড়। পোর্টেবল হার্ডড্রাইভে এই কানেক্টর চোখে পড়বে আপনার। এটা ইউএসবি ৩.০ বা ৩.১ জেনারেশন ১ এর স্পিড পর্যন্ত সাপোর্ট করে।
টাইপ সিঃ
উপরের ইউএসবি এর বিভিন্ন আকার আকৃতি নিয়ে পড়ার পর আপনার মাথায় নিশ্চয় ইতিমধ্যে প্যাঁচ লেগে গেছে। আমার মতো আপনিও নিশ্চয়ই ভাবছেন যে একই ইউএসবি টেকনোলজির মাঝে এতো এতো ভ্যারিয়েন্ট আনার কি দরকার ছিল? সবকিছু একই সাইজের হলে কত সহজেই না এক ক্যাবল দিয়ে সব ডিভাইসে সব কাজ সেরে ফেলা যেত! প্রযুক্তিবিদরাও একই চিন্তা থেকেই টাইপ সি নামক ইউএসবি এর নতুন এক ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে এসেছেন। এটার সাইজ মাইক্রো ইউএসবি এর মতো কিন্তু শক্তি সামর্থ্যের দিক থেকে সব কিছুকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যে ফ্ল্যাগশিপ ফোন কিংবা প্রিমিয়াম সব গ্যাজেটে এই কানেক্টর এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। এটি ইউএসবি ৩.১ ও ইউএসবি ৩.২ সাপোর্ট করে। আশা করা যায় ভবিষ্যতের ইউএসবি ৪.০ টাইপ সি কানেক্টর নিয়েই আসবে। বিজ্ঞানীদের চিন্তা হচ্ছে সব গ্যাজেটে একই কানেক্টর ব্যবহার করে পাওয়ার সাপ্লাই থেকে শুরু করে সব ধরনের ডেটা সাপ্লাই করা যেন বিভিন্ন ক্যাবল নিয়ে আর দৌড়াদৌড়ি করা না লাগে। টাইপ সি এতটাই ভার্সেটাইল যে এটি আস্তে আস্তে এইচডিএমআই, ৩.৫ মিমি অডিও আউটপুটকেও রিপ্লেস করে ফেলছে। মানে সবকিছু হবে টাইপ সি দিয়েই।
ইউএসবি ওটিজিঃ
ইউএসবি এত ফ্লেক্সিবল একটা প্রযুক্তি হলেও এটার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। ইউএসবি হোস্ট- গেস্ট মেথডে কাজ করে। মানে দুটি ডিভাইস ইউএসবি দিয়ে কানেক্টেড থাকলে সহজে ডেটা কিংবা পাওয়ার ট্রান্সফার করার জন্য একটা হোস্ট হিসেবে কাজ করে আর অন্যটি গেস্ট। স্বাভাবিকভাবে পিসি আর ফোন কানেক্ট করলে পিসি হোস্ট আর ফোন গেস্ট হিসেবে কাজ করে। যেহেতু ফোন সবসময় গেস্ট হিসেবে কাজ করে তাই স্বাভাবিকভাবে পিসিতে আপনি কিবোর্ড, মাউস বা এধরনের ডিভাইস ইউএসবি দিয়ে কানেক্ট করাতে পারলেও ফোনের সাথে কানেক্ট করাতে পারবেন না। এই সমস্যা সমাধানে ফোনে এক বিশেষ ধরনের সার্কিট বসানো হয় যাকে বলা হয় ইউএসবি ওটিজি বা অন দ্য গো প্রযুক্তি। আপনার ফোনে এই প্রযুক্তি থাকলে আপনার ফোনটিও পিসির মতো হোস্ট হিসেবে কাজ করবে এবং এর সাথে কিবোর্ড, মাউস, পেনড্রাইভ ইত্যাদি কানেক্ট করাতে পারবেন।
থান্ডারবোল্টঃ
ইউএসবি এর মতো এটিও অন্য একটি ডেটা ট্রান্সফার প্রযুক্তি। এর সর্বশেষ সংস্করণ হলো থান্ডারবোল্ট ৩। থান্ডারবোল্ট ৩ ইউএসবি এর মতো টাইপ সি কানেক্টর ব্যবহার করলেও ইউএসবি আর থান্ডারবোল্ট কিন্তু এক জিনিস নয়। যদিও অনেকে থান্ডারবোল্ট কে ইউএসবি এরই উন্নত ভার্সন করেন। কাজের দিক থেকে থান্ডারবোল্ট এর ফিচার অনেক বেশি। এপল ও ইন্টেল মিলে এই প্রযুক্তি ডেভেলপ করেছে। প্রথমে এটি এপল এক্সক্লুসিভ থাকলেও ২০১৭ সালে ইন্টেল থান্ডারবোল্ট ৩ কে রয়াল্টি ফ্রি করে দেয় যেন অন্যান্য কোম্পানিও এই প্রিজুক্তি তাদের ডিভাইসে ব্যবহার করতে পারে। এর গতি প্রায় ৪০ জিবিপিএস পর্যন্ত। একই সাথে ইউএসবি টাইপ সি এর মতো থান্ডারবোল্ট টাইপ সি কানেক্টরও ১০০ ওয়াট পর্যন্ত পাওয়ার সাপ্লাই সাপোর্ট করে।
আশা করি ইউএসবি নিয়ে বেসিক সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছেন। তার পরেও কিছু জানার থাকলে কমেন্ট বক্স তো আছেই। আর আর্টিকেলটি কেমন লাগলো তা জানাতে রিয়েক্ট বাটন চাপতে ভুলবেন না।
The post যতসব ইউএসবি কানেক্টর appeared first on ATC ToTo.
from ATC ToTo
via ifttt
No comments:
Post a Comment